পুলিশবন্ধু সাক্ষাৎকার ডেক্স:
সপ্তাহে তিনদিন ৫টা করে ক্লাস করতাম। সকাল ৬টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১০টায় বাসায় ফিরতাম। বাকি পাঁচ দিন ফ্রিল্যান্সিংয়ের পেছনে সময় দিই। যে ল্যাপটপে কাজ করতাম ,তা খুব পুরনো ছিলো। এক বছর ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা জমিয়ে ভালো মানের একটি কম্পিউটার কিনি। আমার শুরুর গল্পটা এমনই।
সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ‘ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স ২০২৩’-এ সম্মাননা পেয়েছেন মাহফুজুর রহমান। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা পুলিশবন্ধু কে জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তামান্না ইসলাম
পুলিশবন্ধু : আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানতে চাই।
মাহফুজুর রহমান: আমি মাহফুজুর রহমান। কুষ্টিয়া জেলার খোকশা থানায় আমার বাড়ি। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৮ সালে সিএসই-তে গ্র্র্যাজুশেন করেছি। বর্তমানে ই-কমার্স নিয়ে কাজ করছি।
পুলিশবন্ধু : আপনার ফ্রিল্যান্সিং-এর শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
মাহফুজুর রহমান: আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরু ২০১৮ সালে এবং আমার প্রথম আর্নিং ছিলো মাত্র ১ ডলার। ২০২০ সালে আমি একটি মাল্টিন্যশনাল কোম্পানিতে জব করতাম; যা ৮ মাস করি। যখন দেখি আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারটির জবলাইফ থেকে ভালো। তখনই খুব ভালো চাকরি হওয়ার পরও তা ছেড়ে দিই। ধীরে ধীরে ২০২০ সালে এসে আমি ছোট একটি টিম করার চিন্তা করি। সেই টিমে প্রথম দিকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হই। যেমন- বেতন দেয়া, মার্কেটিংয়ের জন্য লোক রাখা। তখন আমি পরিচিতজনদের মধ্যে লোক খুঁজতে থাকি যে আমার জন্য কম বেতনে কাজ করবে। ধীরে ধীরে মাত্র ৫০০০ টাকার একটি রুম ভাড়া নিয়ে টিম পরিচালনা শুরু করি। তিন জনের মাধ্যমে। এরপর ২০২১ এসে আমি একটি বড় অফিস সেটআপ দেই; যেখানে ২২জন টিম মেম্বার ছিল। তারপর এক সময় মনে হলো, একটি ভলো জায়গায় অফিস নিলে আরও ভালো টিমমেম্বার পাওয়া যাবে। তারপর আমি ২০২২-এর আগস্টে মোহাম্মদপুরের আদাবরে একটি অফিস নেই। এখন আমার কর্মী সংখ্যা প্রায় ৩২ জন। বেশিরভাগকে আমি ট্রেনিং দিই।
পুলিশবন্ধু : ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজের প্রথম কাজ এবং আয়ের অনুভূতি কী?
মাহফুজুর রহমান: আমার প্রথম আয় ছিলো খুবই দুঃখজনক। মাত্র ১৫ ডলারে আমি কাজটি করি। ২০১৮ সালে কাজটি পাই কিন্তু ভালো ধারনা না থাকায় ক্লায়েন্টকে খুশি করতে পারিনি এবং ওয়ান স্টার ফিডব্যাক পাই। এতে আমার প্রোফাইলটি রেস্ট্রিক্টেড হয়ে যায়। অনেক সিনিয়রই বলেছে এই প্রোফাইল দিয়ে আমি আর কাজ করতে পারবো না। এরপর আমাদের কমিউনিটির বিভিন্ন সিনিয়রদের কাছ থেকে সাহায্য নিই। সবাই নতুন আইডির পরামর্শ দিলেও আমি ওই আইডি দিয়েই কাজ করার চেষ্টা করি। আমি ক্লায়েন্টকে বলি, আমি তার জন্য ২-৩ মাস ফ্রি কাজ করবো; তাও যেন তিনি আমার ফিডব্যাকটি সরিয়ে নেন। তিনি এতে রাজি হয়। আমি প্রতিদিন টানা ৮ঘন্টা তার জন্য কাজ করতাম। দুই মাস তাকে ফ্রি সার্ভিস দিই। সেই আইডি দিয়েই এখন আমার দুইটি অফিস এবং ৩২ জনের টিম মেম্বার।
পুলিশবন্ধু: ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ই-কমার্সকে কেন বেছে নিলেন? ফ্রিল্যান্সিং-এ এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনি মনে করেন?
মাহফুজুর রহমান: ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রত্যেকটি খাতই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) দিয়ে। সেখানে যখন দেখি আমার ক্লায়েন্টদের জন্য ওয়েবসাইট ক্রিয়েট করতে হয় তখন আমি ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখলাম। তারপর আমি এসইও বাদ দিয়ে পুরো এক বছর ওয়েব ডেভেলপমেন্টে সময় দিই। তারপর যখন দেখি এখানে ওয়েবসাইট বানিয়ে দেওয়ার পর ক্লায়েন্ট চলে যায়। প্রত্যেক মাসে নতুন নতুন ক্লায়েন্ট খুঁজতে হয় তখন এটি আমার কাছে আলাদা প্রেসার মনে হয়। তাই আমি ই-কমার্স খাতকে বেশি প্রাধান দিই। কারণ এখানে একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট, একটি স্টোর যদি লাইফটাইম থাকে। তাহলে প্রতিনিয়নত আমার কাজ চলতে থাকবে। এখানে একটি বড় ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে বর্তমানে আমি ইউএস বেজড কাজ করছি। ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চাচ্ছি।
পুলিশবন্ধু: ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরুতে কোন বিষয়গুলো বাধা হিসেবে কাজ করেছে এবং সেগুলো থেকে কীভাবে বের হয়েছেন?
মাহফুজুর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে থাকাকালীন সময়ে এসে আমি ফ্রিল্যান্সিং শেখা শুরু করি। তখন পড়ালেখার প্রচুর প্রেসার থাকে। পড়ালেখা এবং ফ্রিল্যান্সিং দুটোই চালিয়ে যাওয়াটা কষ্টকর ছিল আমার কাছে। সপ্তাহে তিনদিন আমি ৫টা করে ক্লাস করতাম। সকাল ৬টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১০টায় বাসায় ফিরতাম। বাকি ৫দিন এই ফ্রিল্যান্সিং এর পেছনে সময় দিই। এছাড়াও আমি যে ল্যাপটপে কাজ করতাম; তা খুব পুরনো ছিল। আমি এক বছর ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা জমিয়ে ভালো মানের একটি কম্পিউটার কিনি।
পুলিশবন্ধু: ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যর্থতার কী কী কারণ হতে পারে? নিজের স্কিলস আর সফলতার ব্যাপারটা কীভাবে দেখছেন?
মাহফুজুর রহমান: বর্তমানে ফ্রিল্যান্সাররা শর্টটাইমে টাকা ইনকাম করতে চান। নতুনদেরকে পারদর্শী এবং খুব এক্সপার্ট হতে হবে। আমাদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে তিনটি লেভেল থাকে- এক্সপার্ট, মিডলেভেল এবং বিগেনার। প্রত্যেকটি বিষয়ে এক্সপার্ট না হয়ে আসলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে লংটার্ম কাজ করা খুবই কঠিন। এছাড়াও আরেকটি কারণ হলো দেখা যায়, একটি স্কিল শিখেই আমরা মার্কেটপ্লেসে আসতে চাই এবং একাউন্ট খুলে মাসের পর মাস আর কোনো খোঁজ রাখি না। এখানে সব ধরনের জ্ঞান নিয়েই আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ই প্রোপার গাইডলাইনের অভাব থাকে।
পুলিশবন্ধু: নতুনদের জন্য সঠিক গাইডলাইনটি কী হতে পারে?
মাহফুজুর রহমান: এখানে ভালো করার একমাত্র উপায় কমিউনিটি নেটওয়ার্ক। যারা সফল হয়েছে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা। আমি অনেক সিনিয়রকে ফ্রি-তে কাজ করে দিয়েছি; যেন আমি তাদের সাথে থেকে তারা কীভাবে সফল হয়েছে সে পথটি খুঁজতে পারি। দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কোর্স করানোর নাম দিয়ে অনেক স্ক্যাম করে থাকে। এগুলো থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
পুলিশবন্ধু: একজন ফ্রিল্যান্সার এর পোর্টফোলিও বিল্ড আপ করার ব্যাপারে কিছু বলুন।
মাহফুজুর রহমান: ফ্রিল্যান্সিংয়ে পোর্টফোলিও বিল্ড আপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নতুন যারা আছে তারা নিজেদের পোর্টফোলিও যতটা স্ট্রং করে ক্লায়েন্টকে দেখাতে পারবে, কাজ পেতে তত সহজ হবে। পোর্টফোলিওতে বিভিন্ন ধরনের স্কিল থাকতে হবে। একটা স্কিল দিয়ে পোর্টফোলিও বানালে অনেক ক্লায়েন্টেরই চাহিদা মতো হয় না।
পুলিশবন্ধু: নতুনদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিতেন
মাহফুজুর রহমান: নতুনদের কিছু বিষয় ভালোমতো অনুসরণ করতে হবে। এক, সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রচুর এক্টিভ থাকতে হবে এবং নিজের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। তাকে সব প্রোফাইলে সময় দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাকে র্যান্ডমলি স্কিল শিখতে হবে এবং ওই স্কিলের উপর এক্সপার্ট হতে হবে। একটা ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্নরকম স্কিল থাকে।
পুলিশবন্ধু: ধন্যবাদ আপনার সময় দেয়ার জন্য।
মাহফুজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ