পুলিশবন্ধু অনুসন্ধান ও কেস স্টাডি ডেক্স:
রাজধানীর বাড্ডা, গুলশান, বনানী, ভাটারা এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দাপট বেড়ে গেছে। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও দেশে ফেরার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম বাড্ডার মেহেদি কলিন্স। এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন অফিস ও দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর, ভয়ভীতি প্রদর্শন, গুলিবর্ষণসহ নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্প্রতি মেহেদি তার সহযোগীদের দিয়ে বাড্ডা, গুলশান, বনানী এলাকায় শোডাউন করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। এর মধ্যেই ৮ নভেম্বর গুলশান ডিসিসি মার্কেটের সামনে গুলশান থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজাল মোল্লাকে (৪৫) কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে।
প্রত্যক্ষদর্শী তার বন্ধু মনির হোসেন বলেন, দুলাল, ইমরান, সাইফুল, লালন, সজল, ইমরান, সোহেল ও সাইদসহ ৮-১০ জন অতর্কিত হামলা চালিয়ে মারধর শুরু করে। এ সময় তার ডান বাহুতে ছুরিকাঘাত করলে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। হামলাকারীরা থানার তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদির সহযোগী। তাদের নামে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
এর আগে ২৮ অক্টোবর বাড্ডা গুদারাঘাট এলাকায় যুবলীগের ২১নং ওয়ার্ড কমিটির কার্যালয়ে মেহেদি কলিন্সের ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করে এবং সাধারণ সম্পাদক মহারাজকে হত্যার হুমকি দেয়। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই ভাবিয়ে তোলার মতো। আমরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। কলকাঠি যেখান থেকেই নাড়া হোক এদের হয়ে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকবে তাদের শক্তহাতে নির্মূল করা হবে। আইনের আওতায় নেওয়া হবে। আমাদের ব্যাটালিয়নগুলোকে এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা করতে বলেছি। এর মধ্যে কারা ভেতরে আর কারা বাইরে আছে, তাদেরও নাম থাকবে।
বিদেশ থেকে অপরাধজগত নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, বিদেশে অবস্থানরত চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ যাবে ইন্টারপোলে। পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজনে এসব সন্ত্রাসীর সহযোগী হিসাবে যেসব আত্মীয়স্বজন অপরাধে জড়িত থাকবে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, আমেরিকায় অবস্থানকারী মেহেদি বাড্ডা, গুলশান, বনানী ও ভাটারা এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৫ বছরে মেহেদি গ্রুপের হাতে এ এলাকায় ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। মেহেদি গ্রুপের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী ডালিম-রবিন গ্রুপের সখ্য রয়েছে। এ ডালিম-রবিন গ্রুপের সঙ্গে বনানী ও মহাখালী এলাকার আত্মগোপনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী সুন্দরী সোহেল গ্রুপের ক্যাডার বাহিনীর ওঠাবসা রয়েছে।
বাড্ডা থানা পুলিশের কাছে মেহেদি নামটি ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকার এক নম্বরে। পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাড্ডা ও গুলশান এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে নিতে মেহেদি ও যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপনকারী অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল এক হয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান-১ এর গুলশান শপিং কমপ্লেক্স ঘিরে চঞ্চল-মেহেদি গ্রুপের ক্যাডার বাহিনী মহড়া দিয়েছে। এ গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড মান্নান, দুলাল, দীপু, বাবুল, অলি, মানিক, সাঈদ, রুবেল, পলক, কান্নি সোহেল, তাহের ও তপন সক্রিয়।
ওই শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ বলেন, গুলশান থানা পুলিশের ইনফর্মার হিসাবেও কাজ করে মেহেদির ডান হাত দুলাল। এ কারণে গুলশান থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফুটপাতের সব ব্যবসায়ীর দোকান পুলিশ বন্ধ করে দিলেও দুলাল ও তাহেরের দোকান খোলা রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদির অপতৎপরতায় বাড্ডা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়াও আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, অটোরিকশা চলাচলের রুটে চাঁদাবাজি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিনিয়ত অস্থির হয়ে থাকে। এসব দ্বন্দ্বে কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মেহেদির নির্দেশে এ এলাকায় সব অপরাধ সংঘটিত হয়। ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও ম্যাসেঞ্জারে চাঁদাবাজি ও খুনের নির্দেশ দিচ্ছে তারা। সম্প্রতি বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান দুখু এবং ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু হত্যাকাণ্ডে মেহেদি গ্রুপ জড়িত বলে স্থানীয়রা বলে আসছেন। এছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডের নতুন মেরুকরণের ওপর নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের কর্মকাণ্ড লিখিত আকারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হচ্ছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীর সঙ্গে কে বা কারা যোগাযোগ করছে এবং তাদের হয়ে পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে এবং এসব সন্ত্রাসীর একটি তালিকাও করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবু সালেহ মামুন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। এ সময়ের মধ্যে সরকারের অন্যতম সাফল্য সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে ছিনতাই-চাঁদাবাজি, হত্যা ইত্যাদি ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর এ এলাকায় পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদি কলিন্সের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সক্রিয় অবস্থানের পেছনে একটি রাজনৈতিক দুরভীসন্ধি রয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা, হত্যা-সন্ত্রাস ইত্যাদি বাড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। আর এ কারণেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সক্রিয় করা হচ্ছে। এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীই সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য কাজ করছে।