পুলিশবন্ধু অনুসন্ধান ও কেস স্টাডি ডেক্স:
অভিনব কায়দায় প্রবাসীদের আত্মীয় স্বজনদের জিম্মি করে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান পণ্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা একটি চক্রের মূলহোতা খোরশেদ আলমসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সেই সঙ্গে অপহৃত একজন ভুক্তভোগীকেও উদ্ধার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) ভোর পর্যন্ত রাজধানীর রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে ১২ টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন খোরশেদ আলম (৫২), জুয়েল রানা মজুমদার (৪০) ও মাসুম আহমেদ (৩৫)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রীসহ প্রায় ৬০ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, যশোরের সৈয়দ আলীর ছেলে প্রবাসী নুরুন্নবী গত ২০ আগস্ট মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান। বিদেশে যাওয়ার পর সেখানে ভালো চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় একপর্যায়ে দেশে ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় প্রবাসে এই চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ এবং তার সহযোগীরা নুরুন্নবীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার ফ্রি টিকেট দেওয়ার প্রলোভন দেখান। তারা তাকে স্বর্ণালংকার এবং একটি লাগেজে বেশ কিছু দামি কসমেটিকস পণ্য, ইলেকট্রনিকস আইটেম, চকলেট দেন। শর্ত ছিল সেগুলো তিনি বাংলাদেশে গিয়ে খোরশেদের কাছে হস্তান্তর করবেন। প্রবাসী নুরুন্নবী তাদের দেওয়া শর্তে রাজি হন এবং ৯ অক্টোবর রাতে ঢাকায় আসবেন বলে তার পরিবারকে জানান।
নুরুন্নবীর বাবা সৈয়দ আলী ৯ অক্টোবর রাতে প্রবাসফেরত ছেলেকে নেওয়ার জন্য ঢাকায় এলে চক্রের সদস্যরা তাদের পাঠানো পণ্য নিরাপদে পাওয়ার জন্য জামানত হিসেবে সৈয়দ আলীকে কৌশলে রাজধানীর শান্তিনগরের একটি বাসায় নিয়ে জিম্মি করে রাখেন। তারা তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন না করলেও বাসা থেকে বের হতে দেননি। পরে এ ঘটনায় নুরুন্নবীর পরিবার তার বাবা নিখোঁজ উল্লেখ করে মিরপুর থানায় একটি জিডি করেন। সেই জিডির সূত্র ধরে এ চক্রের সন্ধ্যান পায় র্যাব।
চক্রটি সম্পর্কে যা বলছে র্যাব
র্যাবের মিডিয়া পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের দাবি, বাংলাদেশি এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আরও বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতিকারীর পরস্পর যোগসাজস রয়েছে চক্রটির সঙ্গে। তারা প্রবাস ফেরত বিভিন্ন যাত্রীদের মাধ্যমে বিগত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে কৌশলে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মূল্যবান পণ্য দেশে এনে বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করে আসছিল। এই চক্রটির অন্যতম মূলহোতা আবু ইউসুফ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে প্রবাসী। দেশে ও বিদেশে এই চক্রটির প্রায় ১২-১৫ জন সদস্য রয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রবাসীদের গ্রুপসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্রি টিকিটে বাংলাদেশে আসার প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। সেই বিজ্ঞাপন দেখে যেসব প্রবাসী ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ ফ্রি টিকেট দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রবাসীর কাছে স্বর্ণ, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের দামি প্রসাধনী ও অন্যান্য মূল্যবান পণ্যের ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওজনের একটি লাগেজ দেন। প্রতিটি লাগেজে আনুমানিক ১০-১৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য থাকত।
আল মঈন বলেন, চক্রটি এমন করার কারণ হলো, অনেক প্রবাসী তাদের মালামাল আনার পর গায়েব হয়ে গেছে। ফলে তারা যতক্ষণ না মালামাল বুঝে পেত ততক্ষণ সেই প্রবাসীর স্বজনকে জিম্মি করে রাখত। পরে মালামাল বুঝে নিত চক্রটি। এরপর সেই মালামালগুলো তারা রাজধানীর গুলিস্তানের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করত। সেই টাকার একটি অংশ প্রবাস থেকে মালামাল কিনে পাঠানো ইউসুফ পেতেন।
চক্রের সদস্যরা কে কী কাজ করতেন
গ্রেপ্তার খোরশেদ ২০০৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান। সেই বছর দেশে ফেরত এসে বাংলাদেশ অংশে এই চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রবাসী ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনকে অপহরণ করে তার ভাড়াকৃত বাসায় জিম্মি করে রাখতেন। প্রবাসী ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রবাসী ব্যক্তির বিদেশ থেকে দেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা, কৌশলে অপহরণ করানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে থাকা চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
গ্রেপ্তার জুয়েল অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা কসমেটিকসের ব্যবসা করতেন। আগেও তার গাজীপুরে সাইকেল ও রিকশার পার্টসের ব্যবসা ছিল। তিনি প্রবাসী ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে অপহরণ এবং বিদেশ থেকে নিয়ে আসা পণ্যগুলো রাখার জন্য বাসা খোঁজ করা এবং বাসা ভাড়া নেওয়ার কাজ করতেন। এছাড়া অবৈধভাবে আনা মালামাল বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো ও বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজও করতেন। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির বিমানবন্দর থানা ও ওয়ারী থানায় একই আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার মাসুম জুয়েলের কসমেটিক্সের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। আগে তিনি ঢাকায় প্রাইভেটকার চালানোর পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।